জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল রফিক। সাদা মেঘ গুলো একে একে ভেসে যাচ্ছে। দক্ষিন থেকে উত্তর দিকে। মেঘের গা ঘেসে অসংখ্য পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। নীল একটা অচেনা পাখি উড়ে গেল সামনে দিয়ে। যত দুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল তত দুর পর্যন্ত তাকিয়ে রইল। চোখটা ঝাপসা হয়ে এল। বেশীক্ষন ভাবতে পারে না রফিক। কিছুক্ষন ভাবলেই কেমন যেন অস্বস্থি লাগে। অসহ্য গরম। কেমন জানি একটা গুমট ভাব। শরীর থেকে জামাটা খুলে ফেলল। পেছনে ফিরতেই অবাক হলো। রুবি ? রুবি এগিয়ে এল। দাও জামাটা আলনায় রেখে দেই। হাত বাড়িয়ে দিল। জামাটা আলনায় রেখে খাটের কিনারায় বসল।
রফিক আবার আকাশ পানে তাকাল। পাখি গুলি আর দেখা যাচ্ছে না। আকাশের নীল নিলিমা ই এখন রফিকের প্রিয়। আগে সে এমন ছিল না। অপলক তাকিয়ে থাকত রুবির দিকে। আজ রুবি তার সামনে কিন্তু তার দিকে তাকাচ্ছেনা। আজকাল রুবির কথা ভাবেনা। রুবিকে ছাড়াই তার জীবন চলে যাচ্ছে। তুমি ? হঠাৎ প্রশ্ন করল রফিক। কেন ? আসতে নেই নাকি- অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকল রুবি রফিকের পানে। না না তা বলছিনা- বলেই আমতা আমতা করতে লাগল রফিক। কি দেখছিলে অমন করে আকাশ পানে। জানতে চাইল রুবি। কিছু না। এমনি এমনি তাকিয়ে ছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কড়ি ডোরে রুবির সাথে প্রথম পরিচয়। কলাভবনে ক্লাস রুমের দিকে দ্রুত হেটে যাচ্ছিল রফিক। রুবি একটি নীল রংয়ের শাড়ী পড়ে কড়িডোরে হাটছিল। হঠাৎ রফিকের সাথে ধাক্কা খায়। রফিক সরি বলে এগিয়ে যাচ্ছিল। রুবি পেছন থেকে বলল সরি বললেই সব। দেখে পথ চলতে পারেন না। কথাট রফিকের ইগোতে লেগে ছিল। সে রুবির সাথে তর্ক জুড়ে দেয়। সেই থেকে রুবির সাথে পরিচয়। ভাল লাগা ভালবাসা। বিশ্ব বিদ্যালয় জীবনে দীর্ঘ পাচটি বছর তারা হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়িয়েছে। কথাছিল রফিক পড়া শেষ করে চাকরি পেলেই তারা ঘর বাধবে। বিধি বাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষানীতির বিরম্নদ্ধে ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো। রফিক বাম ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত। সমাজ পরিবর্তন সহ অবৈধ শিক্ষানীতির প্রতিটি আন্দোলনে রফিক সক্রিয়। রুবি বহু বার তাকে আন্দোলন থেকে দুরে থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। রফিক শোনেনি। শিক্ষা ভবন ঘেরাও কর্মসুচির দিন রফিক ছিল মিছিলের অগ্রভাগে। কার্জন হলের সামনে মিছিল যেতেই অতর্কিতে শুরু হয় গুলি। কিছু বুঝে উঠার আগেই একাটা গুলি এসে রফিকের ডান পাটা ভেদ করে চলে যায়। উঠে পালাতে গিয়ে পড়ে গেল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন হাসপাতালের সুরক্ষিত কক্ষে নিজ কে দেখতে পেল। তার দেখা ঢাকা মেডিকেল এর বেড নয়। এটা কোথায় সে বুঝতে পারছে না। সে বিছান ছেড়ে উঠতে গেল। দেখল তার ডান পা,টা কাটা। সাদা ব্যান্ডেজ করা। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই চোখে জল চলে এল।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে। রৌদ্রের কনাগুলো ঘর ময় ছড়িয়ে ছিল এতক্ষন। নার্স এল রুমের বাতিটা জ্বেলে দিল। নার্সের কাছে জানতে চাইল। এটা কোথায়? নার্স জবাব দিল সি এম এইচ। রফিক বুঝে গেল সে বন্ধী। প্রায় তিন মাস পর রফিককে হাসপাতাল থেকে কোর্টে চালান করা হলো। কোর্টের মাধ্যমে তার স্থান হলো কেন্দ্রীয় কারাগার। দীর্ঘ দুই বছর কারাগারে কাটিয়ে রফিক মুক্তি পেল।
কারগার থেকে মুক্তি পেয়ে রফিক মগবাজারে বাসায় ফিরে এল। ক্রাচে ভর করে জানালার পাশে এসে দাড়ায়। আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রোহ করে উঠে। রফিক মুক্তি চায়। এমনি করে ঘরে বদ্ব খাঁচায় বন্ধি পাখির মত থাকতে থাকতে একদিন সে পাগল হয়ে যাবে।
রুবি কে দেখে তাই নিজের ব্যর্থতায় লজ্জায় ঘৃনায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুবি প্রশ্ন করে কি দেখছ রফিক ? নির্মল আকাশটা। এ ছাড়াতো আর কিছু দেখার মত নেই আমার। এখন তো আমি সকল কাজের বাইরে। আজ যে আমি পঙ্গু। বলতে বলতে রফিকের চোখের কোণে জল এসে গেল। চোখটা মুছে রুবির ফর্সা মুখটার দিকে তাকাল। রফিকের ভীষন সখ ছিল রুবিকে বিয়ে করে ঘরে তোলে হাত দিয়ে ছুয়ে ছুয়ে তার মুখটা দেখবে। রফিক দেখতে পেল রুবির চোখের কোণে জল। রফিকের ডাইরিটা রুবির হাতে। রুবি বলল এখন যাই। তোমর ডাইরিটা------। রফিক বলল রেখে যাও। রুবি কাছে এসে হাতটা ধরল। রফিকের হাতটা কেঁপে উঠল। ইচ্ছে হয়ে ছিল রুবিকে বুকে টানে। পারল না। রুবি চলে গেল।
নীল আকাশে এখন সাদা মেঘ গুলি থরে থরে স্থির হয়ে আছে। রিক্সায় উঠেছে রুবি। বারবার ফিরে ফিরে তাকে দেখছে। রিক্সাটা চলতে শুরু করেছে। রুবি কাঁদছে। পাখি গুলি নীড়ে ফিরছে। ঘরটা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনের সব কিছু ঝাপস হয়ে এল। হেনা এসে ঘরটায় বাতি জ্বেলে দিল। ঝাপসা চোখে আলোটা চিক চিক করে উঠলো।
বিছানায় এসে বসল রফিক। কিছুক্ষন বাতিটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কপালের বা পাশটা চিনচিন করে উঠল। রুবির কথা ভাবতে চাইল রফিক। না পারল না। চোখ জোড়া আপনি সিক্ত হয়ে আসে। একুশে ফেব্রুয়ারীর দিন রুবি রফিকের সাথে প্রভাত ফেরীতে যোগ দিয়ে ছিল । রুবি রাজনীতি পছন্দ না করলেও বিভিন্ন সাস্কৃতিক কর্মকান্ডে রফিকের সাথী হতো । শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে টিএসসিতে এসে অনেক ক্ষণ গল্প করেছিল । রুবির পড়নে ছিল লাল পেড়ে সাদা শাড়ী । রুবিকে সেদিন কি চমৎঁকার যে লাগছিল । বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ জব্বার , সালাম , বরকত , রফিক , শফিক য়েন তার চোখেমুখে ভাসছিল । রফিক তন্ময় হয়ে রুবির মুখ পানে তাকিয়ে ছিল । "২১শে ফেব্রুয়ারী ৫২” ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল আসছে কাজী আলা উদ্দিন রোড থেকে, আসছে চানখার পুল দিয়ে , নাজিম উদ্দিন রোড থেকে, কার্জন হল , এফ এইচ হল থেকে । সারা ঢাকা নগরী যেন মিছিলের নগরীতে পরিনত হয়েছে । সবার মুখে একই রব রাষ্ট্র ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই, বাংলা চাই । মিছিল এগিয়ে চলেছে বটতলার দিকে । মেডিকেলের গেইটে আসার সাথে সাথে ঘাতকের রাইফেল গর্জে উঠলো । মিছিল ছত্র ভঙ্গ হয়ে দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়ল । শত শত লাশ রাজ পথে পড়ে আছে । হঠাৎ রুবি বলে উঠেছিল কি দেখছ অমন করে ? রফিক বলেছিল না কিছু না । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালে প্রতি বছর রুবি আর রফিক একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীতে অংশ নিয়েছে ।
আরেক দিন রফিক রুবিকে নিয়ে বোটানীকেল গার্ডেন গিয়ে ছিল। গার্ডেনের ভেতর বাধানো পদ্ম পুকুর পাড়ে বসে ছিল। পুকুরের পদ্ম ফুল আর পানির নাচন দেখছিল। বাতাসে পানিতে একটা ঢেউ উঠে আবার খান খান হয়ে ভেঙ্গে যায়। রুবি লাল শাড়ী পড়েছে। হলুদ ব্লাউজ। কপালে লাল টিপ। ভীষন ভাল লাগছিল। এ ভাবে সাজলে রুবিকে খুব সুন্দর দেখায়। বার বার একটা ময়লা কাপড় পড়া ছেলে কাছা কাছি ঘোর ঘোর করছিল । ডেকে জানতে চাইলে বলে ছিল চটপটি খাবেন ? রুবি বিরক্ত হয়ে বলে ছিল যা এখান থেকে। তবু ছেলেটা সরেনি। শেষ পযন্ত বিরক্ত হয়ে রফিক ছেলেটার গায়ে হাত তুলে ছিল। মনটা খারাপ হয়ে গেল । উঠে পড়ল। নেমে এল পথে।
গার্ডেনের গেইটের পথে হাটতে হাটতে রুবি বলে উঠে- ছিঃ রফিক ছিঃ । এই তুমি সামাজতন্ত্রের সৈনিক, এই তোমাদের সমাজতন্ত্র । এই হলো তোমদের শোষন মুক্ত সমাজ গড়ার নমুনা। এ দিয়ে তোমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত দেশ গড়বে ? রুবি কি বলতে চাচ্ছে রফিক এর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারল না। কি হলো ? তুমি কার কথা বলছ ? ছেলেটর গায়ে তুমি হাত তুলতে পারলে। তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি রফিক। সরি: ভুল হয়ে গেছে। আমাকে সরি বলছ কেন ? সরি বলা উচিত ছিল নিরীহ গো বেচারা ছেলেটা কে । আসলে পুকুর পাড়ে তোমার পাশে বসে থাকতে ভালই লাগছিল। এ সময় বিরক্ত করায় মেজাজ টা চড়ে গিয়ে ছিল। জানি জানি তোমাদের রাজনীতিবিদদের আমার চেনা আছে । বলেই রুবি চুপ হয়ে গিয়ে ছিল। সারা পথে আর একটা কথাও বলেনি।
সকাল বেলা এক পসলা বৃষ্টি হয়ে গেল। আকাশটা পরিস্কার। মেঘ গুলি যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। ফাল্গুন মাস গাছের কচি পাতা গুলি রোদের আলোতে চিক চিক করছে। রুবি আজ আবার এসে ছিল। শেষ বারের মত। অনেক ক্ষন বসে ছিল রফিকের পাশে। ভাবলেশহীন রফিকের মুখ পানে তাকিয়ে অনেক কেঁদেছে। রফিক বাধা দেয় নি। কাল রুবি চলে যাবে অষ্টেলিয়া স্বামীর হাত ধরে । যাবার বেলায় বলেছে-ভাল থেকো। আচ্ছা চলি।
রুবি বেড়িয়ে গেল। রফিক বিমূঢ়, পাথরের মত স্তব্দ হয়ে রইল। ওর চেতনায় বার বার একটা কথাই ধাক্কা দিচ্ছে, রফিকের মনের দোসর হয়ে আর কেউ রইল না। ও একা হয়ে গেল। এ জীবনের ভার তাকে একাই বইতে হবে। এমন কেউ রইল না যে রফিকের কথা ভেবে আকুল হবে। রফিকের কথা ভেবে হৃদয়ে ভালবাসার বন্যা বইবে। রফিকের পাশে এসে বলবে ভাবনা কি আমিতো আছি। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারীর দিন রফিক কে কেউ প্রভাত ফেরীতে নিয়ে যাবে না ।
নিঃসঙ্গতা,এক দারুন নিঃসঙ্গতা বরফের দেয়ালের মত ঘিরে ধরল চার দিক থেকে। কষ্টের পাথরের নিচে চাপা পড়ে রফিকের দম বন্ধ হয়ে এল। দারুন হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকল। হাতরাল কিছুক্ষন চারদিক। কাউকে পেল না। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রোদের ছায়া
বেশ ভালো লিখেছেন .......... তবে গল্পের সময়কাল টা জানা থাকলে চরিত্র গুলোর অবস্থান, আচার আচরণ , কথা বলার ধরন বুঝতে বেশি সুবিধা হয় ......( সবার লেখার সমালোচনা করে যাচ্ছি নিশ্চিন্তে কারণ হাতের কাছে তো আর আমাকে পাবে না কেও যে ঝারি দিবে )
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।